বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্রের জনক, গ্রামীণ সাংবাদিকতার প্রবাদ পুরুষ, ঊনবিংশ শতাব্দীর কালজয়ী একজন সাধক, সাংবাদিক, লেখক, সাহিত্যিক, সমাজসেবক ও নারী জাগরণের অন্যতম দিকপাল কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার। কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্ত্তা বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র। প্রকাশনার প্রথমদিকে এটি হাতে লিখে প্রকাশ করা হতো। সাংবাদিকতায় কাঙাল হরিনাথের আদর্শ রূপকথার কাহিনীকেও হার মানায়। তিনি সততা, দক্ষতা ও নিষ্টার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নির্ভীক সাংবাদিক কাঙাল হরিনাথ মজুমদার তৎকালীন সময়ে ইংরেজ নীলকর, জমিদার, পুলিশ ও শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন হাতে লেখা পত্রিকা ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকার মাধ্যমে। অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আজীবন আপসহীন। সত্যনিষ্ঠ স্বাধীন মত প্রকাশের নির্ভীকতার জন্য গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার। বহুমাত্রিক প্রতিভাবান গুণিজন কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার ১২৪০ বঙ্গাব্দের (২২ জুলাই, ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ) ৫ শ্রাবণ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের নদিয়া জেলার বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার কুণ্ডুপাড়া গ্রামে মাতা কমলিনী দেবীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন তার পিতার নাম হলধর মজুমদার।তিনি ১৩০৩ বঙ্গাব্দের ৫ বৈশাখ ( ১৮ এপ্রিল ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে) ইহলোক ত্যাগ করেন। কাঙ্গাল হরিনাথের মৃত্যুতে সে সময় ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকা মন্তব্য করেছিল যে, ‘নদীয়া জেলাবাসী একজন মহান ব্যক্তিত্বকে হারালো। তিনি বাঙালি, জাতিসত্তা, বাংলা লোকসংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক। তিনি বাউল সঙ্গীত ও সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন এবং বাংলা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা তার ইতিহাস বাদ দিয়ে কল্পনায় করা যায় না, তার কথা বাদ দিলে সাংবাদিকতার ইতিহাসই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তিনি ফিকির চাঁদ বাউল নামেও অধিক পরিচিত ছিলেন। আধ্যাত্মিকতায় ভরপুর অসংখ্য গান রচনায় অসম্ভব পারদর্শিতার প্রদর্শন করে গেছেন কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার। তার লেখা বাউল গানগুলো ফিকির চাঁদের বাউল গান নামে প্রসিদ্ধ ছিলো। ধর্ম সাধনায় তিনি বহু গান রচনা করে দল বেঁধে সেই গান বিভিন্ন স্থানে গেয়ে বেড়িয়েছেন। কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার অত্যাচারিত, অসহায় কৃষক-সম্প্রদায়কে রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি দারিদ্র্য ও সচেতনতা বিষয়ক লেখনি সংবাদপত্রে প্রকাশ করতেন। প্রথমে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লিখতেন। সংবাদ প্রভাকর পত্রিকাটি এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো। পরবর্তী সময়ে কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার ১৮৬৩ সালের এপ্রিল মাসে কুমারখালী এলাকা থেকে গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। মাসিক এ পত্রিকাটি প্রথমে পাক্ষিক ও শেষে এসে সাপ্তাহিক পত্রিকায় রূপান্তর করা হয়। এ পত্রিকার সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ নিয়মিত ছাপা হতো। নিজের গ্রামের মানুষের ওপর জুলুম, অত্যাচার, দুঃখ-অভাবের ঘটনা সাধারণ জনগণের সামনে আনার জন্য সংবাদ প্রভাকরে তিনি প্রবন্ধ লেখা আরম্ভ করেন। তিনি নিজ উদ্যোগে গ্রাম মানুষের জন্য হিতকর আদর্শ নিয়ে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা প্রকাশ করেন। তিনি একাই ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকার হকার, রিপোর্টার, সম্পাদক, প্রকাশক ছিলেন। কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা পত্রিকাটি গ্রামীণ মানুষের আশা-আকাংখ্যা ও ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। কৃষক-প্রজা-রায়ত-শ্রমজীবী এবং মধ্যবৃত্তের মানুষের আনুকুল্য পেয়েছিল তাঁর এই পত্রিকাটি। এর পাশাপাশি সমাজের চরম অসহায় মানুষের একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিলেন কাঙাল হরিনাথ।এ পত্রিকা কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্নের ছাপার যন্ত্রে মুদ্রিত হয়ে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থেকে প্রকাশিত হতো। এছাড়াও নীলকরদের শোষণের কথাও প্রকাশিত হতো এ পত্রিকায়। তিনি সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন। ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট এবং দেশি জমিদারদের ধারাবাহিক হুমকিও কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারকে তার প্রতিবাদী লেখা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার প্রশাসনের কাজে জড়িত ব্যক্তিবর্গের ভুল-ত্রুটিগুলো গ্রামবার্ত্তা পত্রিকার মাধ্যমে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন। পাবনা জেলার তদানিন্তন ব্রিটিশ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মফস্বল এলাকা পরিদর্শনে এলে এক দরিদ্র বিধবা নারীর একটি দুগ্ধবর্তী গাভী জবরদস্তি করে নিয়ে যায়। এই খবর। কাঙ্গাল হরিনাথের কানে পৌঁছালে তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের এমন অন্যায় কাজের জন্য দীর্ঘদিন ধরে এই ঘটনার জন্য প্রতিবাদ জানিয়ে গ্রামবার্ত্তা পত্রিকায় ফলাও করে ‘গরুচোর ম্যাজিস্ট্রেট শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করেন। গ্রামবার্ত্তা পত্রিকায় ওই সংবাদ প্রকাশ হলে উক্ত ম্যাজিস্ট্রেট কাঙ্গাল হরিনাথের প্রতি রাগান্বিত হন এবং এই লেখাটার জন্য তাকে শায়েস্তা করতে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠেন কিন্তু কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ন্যায় পরায়নতা ও সত্যনিষ্ঠতা এবং জনপ্রিয়তা চারিত্রিক দৃঢ়তার কারণে ওই ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষে। কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারকে ক্ষতিগ্রস্ত করা কখনো সক্ষম হয়নি। পরবর্তী সময়ে সত্যনিষ্ঠ স্বাধীন মত প্রকাশের নির্ভীকতার জন্য কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের প্রশংসায় ওই ম্যাজিস্ট্রেট মুখোর হয়ে ওঠেন এবং লেখেন, ‘এডিটর আমি তোমাকে ভয় করি না বটে কিন্তু তোমার নির্ভীক সত্য লেখনীর জন্য আমি অনেক কুকর্ম ত্যাগে বাধ্য হয়েছি।’ কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার সুদীর্ঘ ১৮ বছর গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা সম্পাদনা করার পর সাংবাদিকতা পেশা ছেড়ে দিয়ে ধর্মসাধনায় মনোনিবেশ করেন। ধর্মভাব প্রচারের জন্য ১৮৮০ সালে তিনি নিজস্ব একটি বাউল গানের দল প্রতিষ্ঠা করেন। দলটি কাঙ্গাল ফিকির চাঁদের দল নামে ব্যাপক পরিচিত ছিলো। কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার গদ্য এবং পদ্য পারদর্শি ছিলেন। বাউল কীর্তন পাঁচালী ছাড়াও গদ্য-পদ্য, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ মিলিয়ে ৪২টি গ্রন্থ রচনা করেন । সাহিত্য অঙ্গনে জলধর সেন, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় ও দীনেন্দ্রনাথ রায় ছিলেন। কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের শিষ্য ছিলেন যারা তারাও নিজ নিজ অবস্থানে অনেক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার ১৮৭৩ সালে (১২৮০ বঙ্গাব্দে) কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কুণ্ডুপাড়া নিজ গ্রামেই ছাপাখানা মথুরনাথ ছাপাখানা (এমএন প্রেস) প্রতিষ্ঠা করেন। এই ছাপাখানাতেই মীর মশারফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু গ্রন্থটি ছাপা হয়েছিল, এবং এই ছাপাখানা কক্ষেই এ কালজয়ী উপন্যাসটির কিছু অংশ রচিত হয়েছিল। জানা যায় এই প্রেস যন্ত্রে রয়েছে কাঙ্গাল হরিনাথ, লালন, মীর মশাররফ ও জলধর সেনের হাতের স্পর্শ। বিখ্যাত লেখক অক্ষয় কুমার মৈত্রর বাবা কাঙ্গাল হরিনাথের বন্ধু মথুরনাথ মৈত্র ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তিনি ছাপাখানার মুদ্রণযন্ত্রটি কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারকে দান করেন। কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার ছিলেন একজন বিদ্যানুরাগী ও সমাজ সচেতন মানুষ। নিজ গ্রামে তিনি বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে একটি ভার্নাকুলার স্কুল খুলেছিলেন। সেখানে তিনি অবৈতনিক শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। পরের বছর তিনি কুমারখালীতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে এই বালিকা বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের উদ্বোধন করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বর্তমানে সেই বালিকা বিদ্যালয়কে জাতীয় করণ করা হয়েছে। কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের স্মৃতি রক্ষার্থে স্থানীয় সাংবাদিকদের দীর্ঘদিনের দাবীর প্রেক্ষিতে সরকার কুমারখালী পৌরসভার সন্নিকটে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রায় সাড়ে আট কোটি টাকা ব্যায়ে একটি দৃষ্টিনন্দন দ্বিতল বিশিষ্ট জাদুঘর নির্মাণ করেছেন। ২০১৭ সালের ৯ ডিসেম্বর জাদুঘরটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এদিকে কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের ভক্ত ও সাংবাদিকদের দীর্ঘদিনের দাবী গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ বহুমাত্রিক কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের প্রতি সম্মান স্বরূপ সাংবাদিকতায় বর্তমান সময়ের নির্ভীক সাংবাদিকদের সাংবাদিকতায় জাতীয় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘কাঙ্গাল হরিনাথ পদক চালু করে গ্রামীণ সংবাদ ও সাংবাদিকতার জনক কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের স্মৃতির যথাযথ মূল্যায়ন করা এবং কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদারের জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে নতুন প্রজন্মের কাছে তাকে উপস্থাপন করা হোক।