বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের একটি ছোট জেলা চুয়াডাঙ্গা। দেশ ভাগের আগে ব্রিটিশ শাসনামলে এই জেলা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ভারতের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর থানা বাদে বাকি সব অংশ কুষ্টিয়ার অধীনে চলে আসে। স্বাধীনতার পর ১৯৮৪ সালে বৃহত্তর কুষ্টিয়া ভেঙ্গে চুয়াডাঙ্গা জেলায় রুপ নেয়। জনশ্রুতি আছে, এ অঞ্চলের মল্লিক বংশের আদিপুরুষ চুঙো মল্লিকের নামেই এই জায়গার নাম হয়েছে চুয়াডাঙ্গা। ১৭৪০ সালে চুঙো মল্লিক ভারতের ইটেবাড়ি থেকে এখানে এসে পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করে। তার সঙ্গে ছিল স্ত্রী তিন ছেলে ও এক মেয়ে। এভাবে গ্রামের পত্তন সেখান থেকেই চুঙো ডাঙ্গা দীর্ঘ কালক্রমে যা এখন চুয়াডাঙ্গা নাম হয়েছে।।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কমান্ড গঠন হয় চুয়াডাঙ্গায়। সেই সময় বাংলাদেশ রেডক্রস বর্তমানে রেডক্রিসেন্ট চুয়াডাঙ্গাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়। সব থেকে মজার বিষয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাক বিভাগ ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা এই চুয়াডাঙ্গায় প্রথম প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার চুয়াডাঙ্গায় গঠন করার কথা ছিল। তবে পরবর্তীতে তা পার্শ্ববর্তী জেলা মেহেরপুরে গঠন করা হয়। চুয়াডাঙ্গার দর্শনা রেলস্টেশনটি বাংলাদেশের প্রথম রেলস্টেশন। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর ব্রিটিশরা দেশের প্রথম রেলপথ চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়া জেলার জাগতি স্টেশন পর্যন্ত চালু করে।
চুয়াডাঙ্গায় দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে অন্যতম ব্রিটিশদের তৈরি চিনিকল দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোং, ঘোলদাড়ি মসজিদ, ঠাকুরপুর মসজিদ, হাজারদুয়ারী স্কুল, নাটুদহ গ্রামে ১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট পাক সেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ আটজন মুক্তিযোদ্ধার কবর। যা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আট কবর নামে পরিচিত। কালুপোল গ্রামে চিত্রা নদীর তীরে আছে ১৪০০ সালের প্রথম দিকে গড়ে ওঠা রাজা গন্ধর্ব রায়ের রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ। জেলার এটাই সব থেকে পুরানো ঐতিহাসিক নিদর্শন, যার স্মৃতি এখনো রয়েছে।
মেহেরপুর জেলাকে আলাদা করে পূর্বদিকে চলে যাওয়া রাস্তাটির নাম তালসারি সড়ক। এটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত চুয়াডাঙ্গার একটি ঐতিহাসিক রাস্তা। ইতিহাসবিদদের মতে তৎকালীন জমিদারের স্ত্রী রাধারাণীর ইচ্ছাতেই পাখি ডাকা, ছায়াঘেরা এই সড়কটি তৈরি করা হয়। ছায়াঘেরা এই সড়কের দুই পাশে তালগাছ থেকে শীতকালে অনেকে রস সংগ্রহ করে থাকে। গ্রামের শ্রমজীবী রহিমা জানান, তার স্বামী ও ছেলেরা মৌসুমের তিন মাস তালের রস সংগ্রহ করে সংসার চালান।
চুয়াডাঙ্গা জেলার বহু গ্রামের নামের সঙ্গে ইতিহাসের অনেক উপাদান রয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেক কবি, সুফি সাধক, আউলিয়াদের আগমন ছিল এই জেলায়। জেলার সচেতন নাগরিকদের দাবি, বাংলাদেশের স্বাধীনতাসহ অনেক কালের সাক্ষী হলেও বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে চুয়াডাঙ্গা। সরকার একটু ইচ্ছা করলেই সৌন্দর্যমণ্ডিত এই জেলা একটি পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে এমনটাই দাবি তাদের।