রাজশাহী জেলায় পুকুর খনন কেন্দ্র করে সংঘর্ষে নারী ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যানসহ পাঁচজন আহত হয়েছে। আহতদের মধ্যে একজনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে শনিবার সকালে উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের মাড়িয়া গ্রামে। পবা থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুকুরখনন কার্যক্রম বন্ধ করে।
এ নিয়ে গ্রামবাসি ও পুকুরখনন সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। এদিকে জোর করে আবাদ যোগ্য জমি ও আমবাগান কেটে অবৈধ পুকুরখননের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ হয়েছে। জমির মালিক আনছার আলী এ অভিযোগ করেন। এছাড়াও মারপিটের অভিযোগেও পবা থানায় অভিযোগ দেয়া হয়েছে।
পুকুরখনন বন্ধের অভিযোগ থেকে জানা গেছে, ভোগ দখলীয় জমিতে জোরকরে চন্দ্রিমা থানার কালচিকা গ্রামের নবাব আলীর ছেলে ড্রেজার ব্যবসায়ী ওমর ফারুক ফারদিন পুকুর খনন করতে থাকে। তার সাথে মাড়িয়া গ্রামের ইব্রাহিম আলীর ছেলে মো. বাবুল হোসেন ও মৃত পাতান আলীর ছেলে সাজ্জাদ আলী অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে এই পুকুরখনন করছে। পুকুরখননে বেশ কয়েকদিন থেকে বাধার দেয়া সত্বেও তারা খননকার্য অব্যাহত রাখে। খননে বাধা দিলে খননকারিরা প্রাণ নাশের হুমকি দেয়। পবা থানায় অভিযোগ দিয়েও পুকুরখনন বন্ধে প্রাণনাশের হুমকির বিষয়ে কোন ধরণের পদক্ষেপ নেয়নি।
সরোজমিন ওই পুকুরপাড়ে উপস্থিত হলে এলাকাবাসী বলেন প্রতি বছরই এরা এই এলাকায় ভিটা জমি ও আম কেটে পুকুর খনন করে আসছে। বাধা দিতে গেলেই দলের ও হামলা-মামলা পুলিশি নির্যাতনের ভয় দেখায়। এ অবস্থায় এদিন সকালে জমি ভোগদখলকারি ও জোর করে পুকুর খননকারিদের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। এর এক পর্যায়ে পুকুরখননকারি ও জমি মালিকসহ গ্রামবাসীর সাথে মারামারি হয়। এতে নারীসহ পাঁচজন আহত হন।
আহতরা হলেন, পারিলা ইউনিয়ন পরিষদের তিন মেয়াদের চেয়ারম্যান মনছুর রহমান, আনছার আলীর ছেলে মাসুদ রানা, মাসুদ রানা মা সালেহার বেগম, মৃত পাতাল মন্ডলের ছেলে ইনছের ও সাইদুল ইলাম। এদের মধ্যে মাসুদ রানাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এতে এলাকাবাসীর মধ্যে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে।
পবা উপজেলায় বেশি লাভের আশায় আমের গাছ কেটে ভিটা জমিতে দেদারছে পুকুর খনন করা হচ্ছে। ভূমি আইন উপেক্ষা করে অবাধে চলছে খননকাজ। রাত দিন সমানে পুকুর খনন করায় কমে যাচ্ছে বাগানসহ তিন ফসলী জমির পরিমাণ।
পাশাপাশি মাটির চাহিদা মেটাতে সারা রাতে মাটি কেটে দেদারছে বিক্রি হচ্ছে টপ সয়েল। বিক্রি করা মাটি পরিবহণের ভারি ডামট্রাক ও ট্রাক্টরের চলাচলে নষ্ট হচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকার গ্রামীণ পাকা রাস্তা সড়ক। এছাড়াও মাটির ট্রাক্টরে প্রতিনিয়তই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। গত কয়েকদিন আগে এই মাটির ট্রাক্টরে কারণে নওহাটায় সড়ক দুর্ঘটনায় চারজন মারা যায়। যারমধ্যে একই পরিবারের শিশুকন্যাসহ স্বামী-স্ত্রী।
রাজশাহীতে পুকুর খননের কারণে আবাদি জমি কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। অপরিকল্পিতভাবে পুকুর খননের জন্য ধানের যে জমি কমেছে এরচেয়ে বেশী ক্ষতি হচ্ছে আবাদে। জলাবদ্ধতার কারণে এক তৃতীয়াংশ জমি অনাবাদি হয়ে পরিত্যাক্ত জমিতে পরিণত হচ্ছে। গত ১০ বছরে বোরো ধানের জমি কমতে কমতে অর্ধেকে নেমে এসেছে। পবা উপজেলার মত রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলেও শুরু হয়েছে পুকুরখনন। এক সময় বোরো ধানের জন্য বিখ্যাত হলেও, এখন সেই খ্যাতি আর নেই।
আমবাগান, তিন ফসলি ও ধানের জমিতে পুকুর খনন বন্ধ করতে পারছেনা প্রশাসন। বর্তমানে রাজশাহীর খালে বিলে যেদিকে চোখ যায় শুধু বোরো জমিতে দেখা মেলে পুকুর আর পুকুর। এখন বোরো জমি বাদেও তিন ফসলি ও বিভিন্ন ফলদ বাগান ধ্বংস করে তা পুকুরে পরিণত করা হচ্ছে। ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাচ্ছে। গত দশ বছর ধরে এই এলাকায় চলছে পুকুর খননের হিড়িক।
এই পুকুর খননের বিষয়ে জেলা প্রশাসন দুষছেন উপজেলা প্রশাসনকে, আবার উপজেলা প্রশাসন দুষছেন জেলা প্রশাসনকে। জেলা প্রশাসন থেকে বলা হচ্ছে সব ধরনের পুকুর খননের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞাজারী রয়েছে। তারপরও উপজেলা প্রশাসনের মদদে ও উদাসিনতার কারণে বারবার একই ব্যক্তিরা ফসলী ও বোরোর জমিতে পুকুর খনন করে চলেছে।
এ ক্ষেত্রে আবার উপজেলা প্রশাসন, বলছেন থানার সহযোগিতায় পুকুর খনন করা হয়। আর পুকুর খননকারীরা বলছেন, পুকুর খনন করতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও থানা শেষে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের টাকা দিতে হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জনকল্যাণে পুকুর খনন নয়, মাটি বিক্রির জন্যই এই পুকুরখননের হিড়িক।