১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণে রাজি করিয়েছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় বাহিনীর চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব।
ভারতীয় এই সেনাকর্মকর্তা জ্যাকব তার লেখা ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন পুরো ঘটনাপ্রবাহ।
জ্যাকব লেখেন, পাকিস্তান সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে গভর্নরের এক বৈঠকের পরিকল্পনা তারা জেনে গিয়েছিলেন। আর ১৪ ডিসেম্বরের এই বৈঠক হামলা করে তারা ভেস্তে দেন। এই হামলা করলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্ব অংশের মনোবল ভেঙে পড়বে বলে তাদের ধারণা ছিল। আর হয়েছেও তা।
তখনকার পুরোনো গভর্নর হাউসে জ্যাকবের ভাষায়- ‘ছেলের হাতের মোয়ার মতো’ অনায়াসে এই হামলার পর পরিস্থিতি একেবারেই বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
১৩-১৪ ডিসেম্বরের রাতে নিয়াজী পাকিস্তানের কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল হামিদের সঙ্গে কথা বলে তাকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার অনুরোধ করেন। ১৪ ডিসেম্বর নিয়াজীর কাছে এক বার্তা পঠিয়ে ইয়াহিয়া অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
নিয়াজীকে পাঠানো ইয়াহিয়ার বার্তাতে লেখা ছিল, ‘প্রবল প্রতিকূলতার মুখেও আপনারা বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছেন। জাতি আপনাদের নিয়ে গর্বিত এবং সারা পৃথিবী প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বিদ্যমান সমস্যার সমাধানকল্পে মানুষের পক্ষে সম্ভব এমন সব পদক্ষেপই আমি গ্রহণ করেছি। বর্তমানে এমন একপর্যায়ে আপনারা পৌঁছেছেন যে, এরপরে প্রতিরোধের যেকোনো প্রচেষ্টাই হবে অমানুষিক এবং সেটা কার্যকরীও হবে না; বরং তা আরও প্রাণহানি ও ধ্বংসেরই কারণ হবে। এই অবস্থায় আপনাদের উচিত হবে যুদ্ধ বন্ধ করে পশ্চিম পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর সব সদস্য এবং অন্যান্য বিশ্বস্ত সহযোগীর জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সমরাভিযান বন্ধ করে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর এবং অন্যান্য জনসাধারণ যারা দুষ্কৃতিকারীদের আক্রমণের লক্ষ্য হতে পারে, তাদের সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভারতকে অনুরোধ করার জন্য আমি ইতিমধ্যেই জাতিসংঘে তৎপরতা চালিয়েছি।’
এই বার্তাটি ভারতীয়রা পেয়ে যান বিকেল ৩টায়। এরপর নিয়াজী ও রাও ফরমান আলি ইউনাইটেড স্টেটস কনসাল জেনারেল হার্বার্ট স্পিভ্যাকের সঙ্গে দেখা করতে যান। স্পিভ্যাককে নিয়াজী যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেন। জবাবে স্পিভ্যাক বলেন, বিষয়টি তার এখতিয়ারের বাইরে। তার পরও তিনি একটি বার্তা পাঠাবেন।
জ্যাকব তার বইয়ে লেখেন, জেক, সত্যি বলছি, নিয়াজির অনুরোধ সম্পর্কে আমি আসলেই কিছু জানি না।
জ্যাকব লেখেন, ‘যতটা বোঝা যায়, ইয়াহিয়া যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছিলেন, যেটা ছিল আত্মসমর্পণেরই নামান্তর।
ঢাকায় আত্মসমর্পণ নিয়ে আলোচনার সময় নিয়াজী আশা করেছিলেন, স্পিভ্যাককে দেওয়া তার প্রস্তাবনা অনুযায়ী দলিল তৈরি করা হবে। কিন্তু সেটি না হওয়ায় ঢাকায় আত্মসমর্পণের দলিল দেখার পরে সেটা গ্রহণ করতে নিয়াজীর অনীহা দেখা যায়।
জ্যাকব লেখেন, পাকিস্তানি সদর দপ্তরে যাওয়ার পথে মুক্তিবাহিনী তাদের থামায়। তারা খুবই উত্তেজিত মেজাজে ছিল। তাদের সঙ্গে ছিলেন বিদেশি সংবাদ সংস্থার কয়েকজন প্রতিনিধি।
জ্যাকব তখন তাদের জানান, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে এবং রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করবে।
এই খবর শুনে মুক্তিযোদ্ধারা খুবই উত্তেজিত হয়ে স্লোগান দিতে থাকে। বলতে থাকে, পাকিস্তানি কমান্ডের সদর দপ্তর দখল করে নিয়াজী ও তার সঙ্গীদের ‘পাওনা’ কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়ে দিতে চায়।
এটা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে জ্যাকবের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেন, বিনা রক্তপাতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে এবং এই সরকারের সদস্যরা ক্ষমতা গ্রহণের জন্য শিগগিরই ঢাকায় এসে পৌঁছাবেন।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেন অবনতি না ঘটে বা কোনও ধরনের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা যাতে না নেয়া হয়, সেটি মুক্তিবাহিনীকে নিশ্চিত করতে বলেন জ্যাকব। বলেন, যুদ্ধবিরতি যেহেতু কার্যকর হয়েছে এবং পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়েছে, জেনেভা কনভেনশনের প্রতি সম্মান দেখাতেই হবে।
এরপর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের যেতে দেয় এবং বেলা ১টায় জ্যাকবরা সেনা সদর দপ্তরে পৌঁছেন।
নিয়াজী তার অফিসে স্বাগত জানান জ্যাকবকে। আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন বেসামরিক বিষয়ের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি, মেজর জেনারেল জামশেদ, নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ, বিমানবাহিনীর এয়ার কমোডর ইমাম ও ব্রিগেডিয়ার বকর সিদ্দিকী।
জ্যাকব তখন নিয়াজীকে বলেন, টঙ্গীসহ বিভিন্ন এলাকায় তখনও সংঘর্ষ চলছে। তার উচিত লড়াই বন্ধের জন্য তার বাহিনীর প্রতি অর্ডার ইস্যু করা।
নিয়াজী যখন অর্ডার ইস্যু করছেন, তখন জ্যাকব তার কাজে মন দেন। আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত সৈন্য ঢাকায় এনে আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা করার ব্যবস্থা করেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঘরোয়া পরিবেশে আত্মসর্পণের প্রস্তাব করলেও জ্যাকব চিন্তা করেন উল্টোটা।
তিনি তার বইয়ে লেখেন, ‘আমি মনে করি, এতদিন যারা নির্যাতিত নিপীড়িত হয়েছে, সেই জনগণের সামনে প্রকাশ্যেই এই আত্মসমর্পণ হওয়া উচিত।’
কিন্তু এর জন্য পর্যাপ্ত সময়ের অভাব ছিল। দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় নিয়ে আত্মসমর্পণ সংক্রান্ত আলোচনা, সব প্রস্তুতি শেষ করতে হবে।
জ্যাকব নিয়াজীকে তাদের প্যারাশুট রেজিমেন্ট ও একটি পাকিস্তানি ইউনিট দিয়ে মেজর জেনারেল গন্দর্ভ সিং নাগরাকে গার্ড অব অনারের আয়োজন করতে বলেন। সেই সঙ্গে আত্মসমর্পণ দলিলে সই করতে একটি টেবিল ও দুটি চেয়ারের ব্যবস্থা করতে বলেন।
এর মধ্যে ভারতীয় ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অন্য কর্মকর্তারা ঢাকায় আসতে থাকেন। ভারতীয় কর্মকর্তাদের অভ্যর্থনা জানাতে জ্যাকব আবার বিমানবন্দরে যান। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার জন্য বিমানবন্দরে একটি দল পাঠানোর নির্দেশও দেন।
এরপর জ্যাকব আবার নিয়াজীর অফিসে ফিরে গেলে কর্নেল খারা আত্মসমর্পণের শর্তগুলো পড়ে শোনান।
জ্যাকব লেখেন, ‘নিয়াজীর চোখ থেকে দরদর করে পানি পড়তে থাকে, সেই সঙ্গে ঘরে নেমে আসে পিনপতন নিস্তব্ধতা। উপস্থিত অন্যদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়।’
নিয়াজীর আশা ছিল, ১৪ ডিসেম্বরে স্পিভ্যাককে দেওয়া তাদের প্রস্তাবনা অনুযায়ী এই দলিল হবে, যেটাতে জাতিসংঘের দেওয়া ব্যবস্থা অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি ও প্রত্যাবর্তন কার্যকর করা হবে।
নিয়াজীকে জ্যাকব বলেন, সৈনিকের প্রাপ্য সম্মান তারা পাবেন এবং জেনেভা কনভেনশন কঠোরভাবে পালন করা হবে। সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলোর নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও দেন তারা। এ ধরনের নিশ্চয়তা ও ধারা ইতিহাসের অন্য কোনও আত্মসমর্পণের দলিলে নেই।