অপরিকল্পিত নগরায়ণের পাশাপাশি অবাধ বস্তির বিস্তারে নাগরিক পরিসেবা ব্যাহত হচ্ছে। বাড়ছে নানারকম সামাজিক ও রাজনৈতিক অপরাধ।
গোয়েন্দা সংস্থার হিসাব মতে, এসব বস্তিতে লক্ষাধিক অপরাধী রয়েছে। তাদের মধ্যে শিশু-কিশোরদের সংখ্যাই বেশি।
তারা বস্তিতে কিশোর সন্ত্রাসী বা বস্তির খুদে রাজা হিসেবে পরিচিত। অনেকের নামে হত্যা থেকে শুরু করে মাদক-ছিনতাই, চুরি, গাড়ি ভাঙচুর ও ডাকাতির একাধিক মামলা রয়েছে। মূলত রাজধানীর বস্তিগুলো এখন অপরাধের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
জানা গেছে, প্রভাবশালী মহল ও রাজনৈতিক নেতারা বস্তির অপরাধীদের ব্যবহার করে নানাভাবে ফায়দা লুটছে।
অস্ত্র-মাদক কেনাবেচা, নারী-শিশু পাচার, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি ও অসামাজিক কার্যক্রমসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে বস্তির অপরাধীরা। প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নানা উদ্যোগ নিয়েও তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না।
রাজধানীর বিভিন্ন বস্তিতে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, এখানে প্রকাশ্যেই চলে মাদক বেচাকেনা। এলাকার উঠতি বয়সী ছেলেরা ক্রমেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই হয়ে উঠেছে বস্তিগুলোর নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এমনকি অপহরণ, খুন-ধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটছে অহরহ।
বস্তিবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বস্তির লোকজন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার মূল কারণ হলো অর্থনৈতিক নিরাপত্তা আর শিক্ষার অভাব। তা ছাড়া বস্তির প্রায় ৯৮ ভাগ মা-বাবা নিজেরা কখনো স্কুলে পড়েনি। ফলে সন্তানদের তদারকির ব্যাপারে তারা সচেতন নয়। কড়াইল বস্তিতে থাকেন আকমল হোসেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসা করেন। তিনি জানান, তার গ্রামের বাড়ি ভোলায়। আগে থাকতেন টিটিপাড়া বস্তিতে। তার আয়ের অন্যতম উৎস এখন মাদক ব্যবসা। এলাকার রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশকে মাসিক মাসোয়ারা দিয়েই তারা এই ব্যবসা করে আসছেন।
কড়াইল বস্তির জুলফিকার আলী (৪০) জানান, তিনি কোনো কাজ করেন না। রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশে বস্তির লোকজনকে নিয়ে যান। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের মিছিল-মিটিং হলেই তার ডাক পড়ে। জনপ্রতি ১০০ থেকে ২০০ টাকা দেয়। তিনি সেখান থেকে কমিশন পান বলে জানান।
জুলফিকার বলেন, নেতারা আমাদের ব্যবহার করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। আর পুলিশও বস্তির লোকজনকে নানাভাবে হয়রানি করে। মালিবাগ রেললাইন বস্তির সোলায়মান ফকিরের বাড়ি ছিল সিরাজগঞ্জ। নদী ভাঙনে সব কিছু হারিয়ে এখন বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি জানান, এখানে সবসময় গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক বেচাকেনা হয়।
জানা গেছে, রাজধানীর আলোচিত কড়াইল বস্তিতে গণধোলাইয়ে মারা যাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী মোশারফ হোসেন মশার উত্থান হয়েছিল এই বস্তিতেই। আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী অঢেল অর্থবিত্তের মালিক গোলাম রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগরও বড় হয়েছিলেন বস্তিতে। মগবাজারের টিঅ্যান্ডটি বস্তিতে বড় হয়ে ওঠেন সুব্রত বাইন। কাফরুলের আগামিয়ার বস্তিতে বেড়ে ওঠেন আরেক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীর। কালা জাহাঙ্গীরের মতো কড়ালই কুমিল্লা পট্টিতে সেভেন স্টার গ্রুপের প্রধান নব্য তাঁতী লীগের নেতা মুমিনেরও জয়ের গান শোনা যাচ্ছে।স্থানীয়দের অভিযোগ কাউন্সিলর মফিজের নেতৃত্বে বহু মামলার আসামি টুন্ডা মমিন বুক ফুলিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন চালাচ্ছেন অপরাধ সাম্রাজ্য। ডালি, টারজান, মোস্তফা, মঞ্জু অবৈধ গ্যাস বিদ্যুৎ সহ ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রণ করেন। ড্রাইভার হাসান, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সুবহান মাওলানা, স্বেচ্ছাসেবক লীগের শিপন, মনির, তাসলিমা বেগম, বাচ্চু, আলামিন।
বস্তির ঘরে অবৈধ গ্যাস–বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ দিয়ে টাকা তোলেন কাউন্সিলরের অনুসারীরা।
কড়াইল বস্তির একটি কক্ষে স্বামীকে নিয়ে ভাড়া থাকেন মমতাজ বেগম। তাঁদের বসবাসের ছোট কক্ষটিতে রয়েছে একটি খাট, একটি ফ্রিজ ও ভাত–তরকারি রাখার একটি স্টিলের মিটসেফ। এ কক্ষে থাকার জন্য তাঁকে মাসে তিন হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। সেখানে বৈদ্যুতিক বাতিসহ অন্তত পাঁচটি খাতে তাঁকে দিতে হয় আরও প্রায় দুই হাজার টাকা। মমতাজ বলেন, একটি কক্ষের জন্য তিনি মাসে ভাড়া দেন পাঁচ হাজার টাকা। এ ভাড়া নেন স্থানীয় কাউন্সিলরের লোকজন।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে তিনটি সরকারি সংস্থার ৯৩ একর জমি দখল করে গড়ে তোলা হয় কড়াইল বস্তি। সেখানে প্রায় ৪০ হাজার ঘর রয়েছে। বস্তি ঘিরে আরও রয়েছে ১০ হাজার ছোট–বড় দোকান। প্রায় পাঁচ হাজার ব্যক্তি এসব ঘর ও দোকানের মালিক। এসব ঘর ও দোকানের অধিকাংশই চলে অবৈধ পানি ও বিদ্যুৎ–গ্যাসের সংযোগে।
কড়াইল বস্তির প্রতিটি কক্ষে দুই থেকে চারজন বাস করেন। ৫ থেকে ১৫টি পরিবারের জন্য রয়েছে একটি শৌচাগার। সকাল-বিকেলে গোসলখানা ব্যবহারের জন্য লম্বা লাইন পড়ে যায়। বস্তির রাস্তার ওপর ময়লা রাখা হয়। অনেক সময় দু–তিন দিনের ময়লা জমে তীব্র দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়।
এসব বিষয়ে একাধিকবার জাতীয় পত্রিকায় লিড নিউজ হলেও বস্তিবাসীর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি।।