সেবাগ্রহিতারা বলছেন, বিআরটিএ কার্যালয়ে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় কোনো সেবা মেলে না। দালাল ছাড়া কাজ করতে গেলে হয়রানি ও ভোগান্তির শেষ থাকে না।
নানা অজুহাত দেখিয়ে সেবাগ্রহিতাদের হয়রানি করেন কর্মকর্তারা।
তবে কর্মকর্তারা হয়রানি ও দালালদের দৌরাত্ম্যের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
তারা বলছেন, কোনো হয়রানি ছাড়াই স্বাচ্ছন্দ্যে সেবা পাচ্ছেন নাগরিকরা। যদিও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ইতোপূর্বে কয়েকবারই ঘোষণা দিয়েছেন, বিআরটিএ এখন দালালমুক্ত, ঘুষ- দুর্নীতি মুক্ত।
এখন সাধারণ মানুষ সেখানে নির্বিঘ্নে সেবা পায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, যে যাই বলুক তাজুল ইসলাম ও আমিনুল ইসলামের সৃষ্ট দালালদের সহায়তা ছাড়া মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ে সেবা পাওয়া দুষ্কর।
সবধরনের গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলেও টাকার বিনিময়ে মিলছে লাইসেন্স। এই অসাধ্য কাজটি সম্ভব করেন মোটরযান পরিদর্শক তাজুল ইসলাম ও তার আস্থাভাজন আমিনুল ইসলামের মাধ্যমে দালালচক্র।
জানা যায়, মোটরসাইকেলের লাইসেন্সের ক্ষেত্রে ব্যাপক বাণিজ্য করছে তাজুল-আমিনুল ইসলাম ও তাদের পৌষ্য দালালচক্র। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলেও চুক্তি করে লাইসেন্স দালালদের মাধ্যমে লাইসেন্স বানিয়ে দেয় তাজুল- আমিনুল। বিনিময়ে লাইসেন্স প্রতি ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা অবৈধভাবে হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা। যদিও বাইকের সরকারি লাইসেন্স ফি মাত্র আড়াই হাজার টাকা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ে গাড়ির লাইসেন্স, ড্রাইভিং লাইসেন্স, মালিকানা হস্তান্তর, ফিটনেস সার্টিফিকেট ও গাড়ির নিবন্ধনসহ যে কোনো কাগজপত্র সম্পাদন সাধারণ প্রক্রিয়ায় কেউই সহজে সম্পন্ন করতে পারেন না। নানা ক্রটি-বিচ্যুতির কথা বলে মানুষকে দালালদের দিকেই ঝঁকিয়ে দেন তাজুল- আমিনুল গং।
সরজমিনে দেখা যায়, মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ের ভেতরে স্টেশনারি দোকানের কর্মচারীদের নেতৃত্বে দালাল সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। কার্যালয়ের প্রবেশ গেট, ব্যাংক, বুথ ও বাদামতলায় সর্বত্র দালালরা তৎপর। মূল ফটকের পাশে স্ট্যাম্প, ফটোকপির দোকানগুলো এ দালালদের মূল আস্তানা।
দেখা যায়, মোটরসাইকেলের নম্বর প্লেট পেতে লাইনে দাঁড়ালে দালালরা তৎপর হয়ে ওঠেন। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে নম্বর প্লেট পেতে অনেকে ভোগান্তি পোহাতে চান না, তাই দালালরা কৌশলে লাইনের সামনের দিকে নিয়ে আসেন বাইক। এ সিরিয়াল দেওয়ার নামে প্রতিজনের কাছ থেকে ৪শ টাকা হাতানো হয়। এছাড়াও ডিজিটাল নম্বর প্লেট বসাতে স্টিলের প্লেটটি ১২শ থেকে ১৫শ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে। অথচ এটার মূল্য সর্বসাকূল্যে ১শ টাকা।
সরজমিনে দেখা যায়, বিআরটিএ অফিসের সামনের সড়কে ফিটনেস সার্টিফিকেটের জন্য যানবাহনের দীর্ঘ লাইন। বেশির ভাগই প্রাইভেটকার। এছাড়া ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, সিএনজি অটোরিকশাও রয়েছে। নতুন ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আসা লোকজনের ভিড় থাকায় দালালদের ছোটাছুটিরও অন্ত নেই।
তাজুল – আমিনুলসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাদের আর্শীবাদপুষ্ট কয়েক শ দালাল ছাড়াও কার্যালয়টির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার বাহিনীও প্রকাশ্যে দালালী করছে।
দেখা যায়, প্রধান গেটের সামনে ৫০০ টাকার দেয়া হচ্ছে নাম্বার প্লেট। এ টাকা না দিলে নম্বর প্লেট যে কতদিনে মিলবে, তার কোনো হিসাব নেই। নম্বর প্লেট লাগাতে ব্যস্ত ব্যক্তির পাশেই একটি ব্যাগে নম্বর-প্লেট লাগানোর ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দুই কিশোর। তাদের হাতে ২শ টাকা না দিলে কোনোভাবেই লাগানো সম্ভব হয় না নম্বর প্লেট।
এক নম্বর ভবনের নিচে যেতেই দেখা যায়, লোকজনের ভিড়ে পা ফেলার তিল পরিমাণ জায়গাও যেন নেই। সেখানে দুই-আড়াই ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেও ছবি তোলার সিরিয়াল মেলে না। তবে পাশেই দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের হাতে ২শ টাকা গুঁজে দিলে ৫-১০ মিনিটের মধ্যেই ছবি তোলা সম্পন্ন হয়ে যায়। টাকা দিলে হয়রানি-ভোগান্তি ছাড়াই চাহিদামাফিক কাজ সম্পাদন হয়ে যায়। এ হচ্ছে মিরপুর বিআরটিএ কার্যালয়ের আসল চিত্র।
সেবা নিতে আসা রাজধানীর কল্যাণপুরের বাসিন্দা আলী আসিফ শাওন বলেন, সাধারণ প্রক্রিয়ায় সেবা পেতে অযথা হয়রানি করা হচ্ছে। অথচ তাজুল ইসলাম বা আমিনুল ইসলামের দালালদের দিয়ে দ্রুত কাজ করা যাচ্ছে।
লাইসেন্স নিতে আসা হাবিব বলেন, একটি লাইসেন্স নিতে কমপক্ষে অতিরিক্ত ১০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে পুনঃপরীক্ষার জন্য দিতে হয় কমবেশি তিন হাজার টাকা। পেশাদার লাইসেন্সের পুলিশ তদন্ত শেষে প্রতিবেদন পেতেও ঘুষ লাগে। এখানে ঘুষ না দিলে তদন্ত প্রতিবেদন মাসের পর মাস খুঁজে পাওয়া যায় না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ কার্যালয়ে সেবা পেতে কোনো হয়রানির শিকার হতে হয় না বলে দাবি করেন সংস্থাটির উপ-পরিচালক (প্রকৌশল) মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, এখানে দালাল ছাড়া নির্বিঘ্নে সেবা নিতে পারেন যে কেউ।