সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতায় এদেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার যবনিকাপাত ঘটতে পারে।” দেশে এমন একটি আলোচিত হত্যা ঘটনায় একযুগ সময়কালে দাড়িয়েও প্রশাসনের তদন্তকাজ সম্পন্ন করতে না পারা চরম লজ্জা, দায়িত্বহীনতা এবং পক্ষপাতীত্বের ঈঙ্গিত বহন করে। অন্যদিকে বিচার কাজে দীর্ঘসূত্রিতায় আইন-আদালতের প্রতি গোটা জাতির প্রকাশ্যে বিরুপ মন্তব্য আজ চোখে পড়ার মত।
রাজধানীতে নিজ ঘরে এক সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকান্ডের ঘটনার বিচার প্রক্রিয়াকে নিয়ে জাতির সামনে যে তালবাহানা করা হচ্ছে তার দায়ভার সাংবাদিক সংগঠন, সাংবাদিক নেতারাও এড়াতে পারেন না। খুনের ঘটনার সাথে একযুগ ১২ বছর, ৪৮ ঘন্টা, ১০৫ শব্দগুলো সাংবাদিকতা পেশার মর্যাদা চরমভাবে লঙ্ঘিত করে।
তবে, কেউ কেউ বলেছেন সাগর-রুনি হত্যার বিচার আসলে সাংবাদিকরা কখনো মনে প্রাণে চায়নি। তারা যদি শক্ত অবস্থানে থাকতো তবে এ বিচার বহু আগেই সম্পন্ন হতো। কোন কোন সাংবাদিক নেতারা এ হত্যাকান্ডকে পুঁজি করে রাষ্ট্রের উঁচুতম পদপদবী লাভ করেছেন,কেউবা অর্থনৈতিক সুবিধা পেয়েছেন।
দীর্ঘ এক যুগেও যে একটি আলোচিত-চাঞ্চল্যকর জোড়াখুনের তদন্ত প্রতিবেদন প্রশাসন দাখিল করতে পারলোনা তাহলে প্রশ্ন জাগতে পারে হত্যাকান্ডটির সাথে তবে কত বড় মাপের শক্তি জড়িত? কেনইবা হত্যাকান্ডের বিচারে এতো দীর্ঘসূত্রিতা?? কেনইবা শতাধিক বার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে আদালতে সময় চাওয়া হচ্ছে? কেনইবা শতশত বার আদালতের বিজ্ঞ বিচারক তদন্তকারী সংস্থাকে তদন্তের জন্য এতো সুযোগ দিচ্ছেন! এতে কি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়না??
সাগর-রুনি হত্যার এক যুগ, ১০৫বার পেছালো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার দিনক্ষণ। এ ঘটনায় সাংবাদিক সমাজ উদ্বিগ্ন, বিচার নিয়ে পরিবারও শংকিত।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের এক যুগ পূর্ণ হলো ১১ ফেব্রুয়ারি। এত বছরেও বহুল আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের কারণ জানাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
র্যাব পাঁচ বছর আগে আদালতে জমা দেওয়া অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলেছিলেন ঘটনাস্থলে দুজন অজ্ঞাত পুরুষের ডিএনএর নমুনা পাওয়া গেছে। তবে এখন পর্যন্ত সেই দুজনকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন এখন পর্যন্ত আদালতে জমা দেওয়ার তারিখ ১০৫ বার পিছিয়েছে।
প্রসঙ্গত: ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর ও রুনি। সাগর সে সময় চ্যানেল মাছরাঙা টিভিতে এবং রুনি এটিএন বাংলায় কর্মরত ছিলেন।
খুনের ঘটনার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে’। খুনের দুই দিন পর পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহামুদ খন্দকার বলেছিলেন ‘তদন্তের ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে’।
এদিকে ছয় দিন আগে ৫ ফেব্রুয়ারি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জাতীয় সংসদে বলেন, ‘একটা জিনিস আমাদের লক্ষ্য করতে হবে, যাঁরা তদন্ত করেন, তাঁরা যতক্ষণ পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের ইয়ে (রহস্য) উদ্ঘাটন না করতে পারেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তদন্ত শেষ করা সমীচীন হয় না’। এই মামলার তদন্ত একটু কঠিন। তদন্তকারী সংস্থা সঠিকভাবে তদন্ত করে এ মামলার সুরাহা করবে। যাঁরা অপরাধী, তাঁদের অবশ্যই ধরা হবে।’
এক যুগেও খুনি ধরা না পড়ায় চরম হতাশ সাংবাদিক সাগরের মা সালেহা মনির। তিনি গণমাধ্যমে বলেন, ‘আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যত দিন সাগর-রুনির প্রকৃত খুনিরা ধরা পড়বে না, তত দিন ওদের কবর দেখতে যাব না। কিন্তু আমি সেই প্রতিজ্ঞা বোধ হয় রাখতে পারব না।’ তিনি বলেন, ‘আমার বয়স (৭৩ বছর চলছে) হয়েছে। প্রায়ই অসুস্থ থাকি। কখন কী হয় জানি না। তাই ভেবেছি, শিগগির সাগর-রুনির কবর জিয়ারত করতে যাব।’
আক্ষেপ করে সাগরের মা আরও বলেন, ‘অনেক খুনের মামলার জট খুলেছে সিআইডি, পিবিআই ও র্যাব। আমি বিশ্বাস করি, খুনি যেখানেই পালিয়ে থাকুক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চাইলেই সেটি বের করতে পারে। কিন্তু কোন অদৃশ্যকারণে র্যাব সাগর-রুনির খুনিদের ধরতে পারছে না, সেটি আমার বোধগম্য হয় না।’
এদিকে কণ্যা হত্যার বিচার না দেখে দুই বছর আগে মারা গেছেন রুনির মা নূরণ নাহার মির্জা। খুনের সময় এই সাংবাদিক দম্পতির ছেলে মাহির সরওয়ারের (মেঘ) বয়স ছিল সাড়ে চার বছর। সে এখন ইংরেজি মাধ্যমের ‘ও’ লেভেলে পড়ে।
এক যুগের তদন্তে কী পেল র্যাব
২০১৭ সালের ১৫ মার্চ র্যাবের পক্ষ থেকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে সর্বশেষ অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী মাহিরের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আটজনকে। অবশ্য বিগত পাঁচ বছরে র্যাবের পক্ষ থেকে খুনের কারণ সম্পর্কে আদালতকে আর কোনো তথ্য জানানো হয়নি।
তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গত বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, সাংবাদিক সাগর ও রুনির খুনিদের শনাক্তের জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে র্যাব।
আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, যে আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে পাঁচজন অন্য একটি খুনের মামলার আসামি। তাঁদের বিরুদ্ধে চুরি ও ডাকাতির অভিযোগও রয়েছে। তাঁরা এখনো কারাগারে।
একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল এই যুগে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে বাংলাদেশের বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এদেশের সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, র্যাব-পুলিশের সুখ্যাতি রয়েছে বিশ্বব্যাপী। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া যেকোন ধরনের ঘটনার তদন্তের জন্য রাষ্ট্রীয় বাহিনী যথেষ্ট। তার মাঝে গত এক যুগ ধরে সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের ঘটনা তদন্ত নিয়ে যে তালবাহানা চলছে তাতে কিন্তু গোটা বিশ্বে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ইমেজ নষ্ট হচ্ছে, যা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভেবে দেখা উচিত।
লেখক: আহমেদ আবু জাফর, চেয়ারম্যান, ট্রাস্টি বোর্ড ও সভাপতি, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি,বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম-বিএমএসএফ।