মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুজিবনগর ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রীয় মনোগ্রাম প্রনেতা স্বর্গীয়এন, এন সাহা আজও মরনোত্তর স্বীকৃতি পাননি। বর্তমানে তার পুত্র মানবেতর ভাবে জীবনযাপন করছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রীয় মনোগ্রামটি ভারতের নদীয়া জেলার কুলগাছি (কৃষ্ণনগর) গ্রাম থেকে তৈরী করা হয়েছিল। মনোগ্রামটি প্রনয়ন করে চুয়াডাঙ্গার বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রখ্যাত ভাষাসৈনিক, বিশিষ্ট কবিরাজ ও দেশ বরেণ্য বুদ্ধিজীবী প্রয়াত এন এন সাহা ১৯৭১ সালে ২৮শে মার্চ দক্ষিণ পশ্চিম রনাঙ্গনের প্রধান উপদেষ্টা ডাঃ আসহাব উল হক বেলা ২টার সময় জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন অর্থ সম্পাদক মরহুম দোস্ত মোহাম্মদ আনসারীকে এন এন সাহার বাসাতে পাঠান এবং অফিসে দেখা করতে বলেন।
এন এন সাহা ঐ সময় উনার সাথে যান এবং ডাঃ আসহাব উল হকের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ডাঃ হক ঐ সময় বলেন- মুজিবনগর সরকার পরিচালনার জন্য মনোগ্রামযুক্ত সীল মোহর প্রয়োজন। কি করলে ভালো হয় বলুন। ঐ সময় এন এন সাহা তিনটি ডিজাইন করে ডাঃ হককে দেখান। তিনি একটি পছন্দ করেন। যাতে লেখা ছিল “দক্ষিণ পশ্চিম রণাঙ্গন-বাংলাদেশ” মাঝে ছিল বাংলাদেশের ম্যাপ। তিনি মনোগ্রামটি প্রনয়ন করে ১৯৭১ সালের ২রা এপ্রিল সরবরাহ করেন।
১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি চুয়াডাঙ্গাতে চুড়ান্তভাবে হওয়ার কথা থাকলেও তথ্যটি ফাঁস হয়ে পড়ায় পাক বাহিনী অবিরাম চুয়াডাঙ্গাতে বিমান হামলা চালায়। ফলে মুজিবনগরে মন্ত্রীপরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়। তবে সামগ্রিকভাবে কার্যক্রম চুয়াডাঙ্গাতে পরিচালিত হত। পরবর্তীতে পাক হামলার মাত্রা বেড়ে যায়। ঐ সময় এন এন সাহা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সংসারের যাবতীয় মালামাল ফেলে খালি হাতে স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাদের নিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অবদানের জন্য ঐ সময় রাজাকাররা এন এন সাহার বাসভবনে এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায় এবং লুটতরাজ করে। ভারতের নদীয়া জেলার কুলগাছি গ্রামে অবস্থানের সময় এন এন সাহা মানবেতরভাবে জীবন যাপন করেন। বাধ্য হয়ে শরণার্থীর তালিকায় নাম লিখাতে বাধ্য হন।
অবিরাম বোমা বর্ষণের ফলে মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রম সরিয়ে নেওয়া হয় এবং একটি আঞ্চলিক দপ্তর নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে স্থাপন করা হয়। যখন ভয়াবহ যুদ্ধের রুপ নেয়- তখন হঠাৎ করে কিছু ভারতীয় বাহিনী এন এন সাহাকে খুঁজে বের করেন এবং কৃষ্ণনগর অফিসে নিয়ে যান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন স্বাধীন বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, এখন আর দক্ষিণ পশ্চিম রনাঙ্গনে সীল প্রয়োজন নেই। এখন দরকার রাষ্ট্রীয় মনোগ্রামযুক্ত সীল মোহর। ঐ সময় দক্ষিণ পশ্চিম রনাঙ্গনের মনোগ্রামটি সামান্য পরিবর্তন করে বাবু এন এন সাহা ডিজাইন করে দেখান। তাতে লেখা ছিল- “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার” মাঝে ছিল বাংলাদেশের ম্যাপ। এই হল বাংলাদেশের সরকারের রাষ্ট্রীয় সীল মোহর তৈরীর ইতিহাস। এন এন সাহা জাতীয় গেজেট, ডাটা বেইজ, মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র ও মুক্তিবার্তা তালিকাভূক্ত বীরমুক্তিযোদ্ধা। তিনি এবং তার স্ত্রী এমনকি পুত্ররা আজ পর্যন্ত ভাতা পাননি। মুক্তিযোদ্ধা সনদ নং ম-৯৪২৫৭, মুক্তিবার্তা নং-০৪০৬০১৪০৪, ডাটাবেইজ নং ০৪০২০১০১০৯ ও জাতীয় গেজেট নং ২৯২। ভাতা প্রদানের ব্যাপারে সরকারের জরুরী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। সেই মনোগ্রামটি আজো রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে অথচ মূল্যায়ন হয়নি মনোগ্রাম প্রণেতা এন এন সাহার। তিনি এবং তার স্ত্রী বিমলা বালা সাহা বিনা চিকিৎসায় পরলোক গমন করেছেন। চিকিৎসার জন্য রাষ্ট্রের কাছে সাহায্য চেয়ে কিছুই পাননি। মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুর পর সৎ কাজের জন্য এককালিন অনুদান দেয়া হয় তা থেকেও এনএন সাহার পরিবার কে বঞ্চিত করা হয়েছে। তবে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করায় তিনি সব কিছু হারিয়েছেন। সোনার সংসার ভেসে গেছে। একমাত্র ভিটাবাড়ীটুকু তার বড় ভাই গৌরপদ সাহা জালিয়াতী করে আত্মসাৎ করেছেন। দ্বারে দ্বারে ঘুরে বাড়ীটুকু উদ্ধার করতে পারেননি। তার ছেলেরা আজ পথে পথে ঘুরছেন। অসহায়ভাবে করছেন জীবন যাপন। দেশ স্বাধীনের পর ফিরে এসে কিছু ফিরে পাননি। গত ২৫/০৫/১৯৮৪ ইং তারিখে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ মহোদয় এক পত্র মারফত এবং গত ২৭/০৮/১৯৯২ ইং তারিখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া মহোদয় তার দপ্তরে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে বাবু এন এন সাহাকে স্বীকতির জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু বার বার রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে তা ব্যাহত হয়েছে। সাহার পারিবারিক সুত্রে জানা গেছে- বর্তমান সরকারের নিকট ২১/২২টি পত্র দিয়েছেন। এ পর্যন্ত কোন উত্তর পাননি। বাবু এন এন সাহার পুত্র বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গীতিকার চিত্তরঞ্জন সাহা চিতু দাবী করেছেন তার বাবার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ, পৌত্রিক ভিটাবাড়ী উদ্ধার এবং বেঁচে থাকার জন্য পুনর্বাসন সহ মুক্তিযোদ্ধার ভাতা প্রদান করতে হবে।
আজ এন এন সাহা নেই। তাঁর স্মৃতি বিলীন হতে চলেছে। তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য অবিলম্বে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। কেননা যে মানুষটি মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে জন নন্দিত হয়েছেন। হয়েছেন নিঃস্ব ও বাস্তহারা। সেই মানুষটির জন্য রাষ্ট্রর কিছু করা প্রয়োজন যাতে নতুন প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানতে পারে। আমরা আশা করবো সরকার শিঘ্রই এন এন সাহাকে মরনোত্তর স্বীকৃতি ও তার অসহায় পুত্রের পুনর্বাসন করে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে সঠিক মূল্যয়ন করবেন।
লেখক (চিত্তরঞ্জন সাহা চিতু)
গীতিকার, কবি ও সাংবাদিক
বড় বাজার, চুয়াডাঙ্গা।
মোবাঃ ০১৮১৮-৩৪৩৯৩৬