কয়েক মাস ধরে শান্তিপূর্ণভাবে পাল্টাপাল্টি সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দুই পক্ষের এমন সমাবেশে বিদেশিরাও প্রশংসা করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকেও সহনশীল রাজনীতির উদাহরণ টানা হয়েছে। তবে ২৮ অক্টোবরের সমাবেশ ঘিরে উদ্বেগের কারণ ১৭ বছর আগের এই দিনটির স্মৃতি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ঘিরে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের পাশাপাশি এলাকায় সমাবেশ ছিল। কিন্তু হঠাৎ দলগুলোর নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। দিনভর সংঘাত সহিংসতার বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়। এক পর্যায়ে জারি হয় জরুরি অবস্থা। সেই একই ইস্যু নিয়ে আগামী ২৮ অক্টোবরেও এই তিন দলের সমাবেশে ঘিরে রাজনৈতিতে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাজধানীজুড়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
আওয়ামী লীগ নেতাদের হুঁশিয়ারি
বিএনপির পক্ষ থেকে ২৮ অক্টোবর শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি শেষ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে, জনগণের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে রাজধানীর প্রতিটি পাড়া-মহল্লার মোড়ে নেতাকর্মীদের সতর্ক পাহারায় থাকতে বলেছে ক্ষমতাসীন নেতারা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আমরা কাউকে আক্রমণ করব না, এই পর্যন্ত করিনি। এবার আমরা সতর্ক পাহারায় আছি, আক্রমণ করলে পাল্টা আক্রমণ হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, আগামী ২৮ অক্টোবর ঢাকা শহর থাকবে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের দখলে। সমাবেশে ১০ লাখ লোকের সমাগমের মাধ্যমে বিএনপির কবর রচনা করা হবে। সারাদেশ থেকে ঢাকায় যে সন্ত্রাসীদের ঢুকিয়েছে বিএনপি, ঢাকাবাসীর শান্তির শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ওই সব সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করা হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপারেশেনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ২৮ তারিখ আমি আপনাদের সঙ্গে রাজপথে থাকব। ২০০৬ সালেরে ২৮ অক্টোবর যেমন আমরা লগি-বৈঠা নিয়ে গণতন্ত্রকে রক্ষা করেছিলাম, তেমনি এই ২৮ অক্টোবরও আমরা গণতন্ত্রকে রক্ষা করব।
বিএনপির বড় জমায়েতের প্রস্তুতি
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ২৮ অক্টোবর সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবি আদায়ে সারাদেশ থেকে গণমানুষের ঢাকামুখী প্রবল তরঙ্গ, স্রোত ধেয়ে আসছে। স্বৈরাচার পতনের আওয়াজ আসছে রাজপথ থেকে। ফুঁসে উঠেছে গোটা দেশবাসী।
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ২৮ অক্টোবরের সমাবেশের মধ্য দিয়ে আমরা সরকারকে একটি বার্তা দিতে চাই। চাপ প্রয়োগ করে দাবি আদায় করতে চাই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিতে সরকারকে বাধ্য করা হবে। মহাসমাবেশ বাধা দিলে এর সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, আগামী ২৮ অক্টোবর আওয়ামী সরকারের বিদায় ঘণ্টা শুরু হবে। পুরো ঢাকা শহর থাকবে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দখলে। মামলাপ্রাপ্ত প্রায় ৪০ লাখ নেতাকর্মী ঢাকা শহর দখলে রাখবে।
সতর্ক অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
তিন দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে যেকোনো ধরনের সংঘাত এড়াতে প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি নিয়েছে পুলিশ। সমাবেশ ঘিরে শুক্রবার (২৭ অক্টোবর) বিকেল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে র্যাব।
র্যাব সদরদপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের সহকারী পরিচালক সিনিয়র এএসপি আ ন ম ইমরান খান বলেন, সমাবেশকে কেন্দ্র করে জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা ও যে কোনো ধরনের নাশকতা প্রতিরোধে রাজধানীতে র্যাবের দেড় হাজারের অধিক সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, সমাবেশ ঘিরে আমরা এখন পর্যন্ত কোনো শঙ্কা অনুভব করছি না। তবে সবকিছু বিবেচনায় রেখে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কেউ যদি জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ব্যবস্থার হুমকির সৃষ্টি করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকা মহানগর (ডিএমপি) পুলিশের কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেছেন, সংবিধানে যে কোনো রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক আন্দোলন, মিছিল, মিটিং ও সমাবেশ করার অধিকার রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে পুলিশ নিরাপত্তাও দিয়ে থাকে। কিন্তু কর্মসূচির আড়ালে কেউ সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করলে কঠোর হস্তে দমন করা হবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেছেন, সমাবেশকে ঘিরে ঢাকায় লাখ লাখ মানুষের জমায়েত হবে। এ কারণে ঢাকা শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছে পুলিশের টহল টিম। ঝুঁকির কথা বিবেচনা করেই থানা পুলিশ, ডিবি পুলিশ ও অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল ও চেকপোস্ট জোরদার করা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি করা হচ্ছে।
র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানিয়েছেন, সমাবেশের সময় যাতে নাশকতার জন্য কেউ কোনো অস্ত্র ও বিস্ফোরক বহন করতে না পারে সেজন্য ২৮ অক্টোবর ঢাকার প্রবেশ পথগুলোতে তল্লাশি চৌকি বসাবে র্যাব।
বিদেশিদের নজর
বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন ভিসা নীতি আরোপ করে তার প্রয়োগও শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাদানকারীদের ভিসা দিচ্ছে না দেশটি। ভিসানীতির আওতায় চিহ্নিত ব্যক্তি এবং তার পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, সব পক্ষের শান্তিপূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করতে পারাটা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তারা বাংলাদেশে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সহিংসতাহীন নির্বাচন চায়।
নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পরিস্থিতি ‘নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে’ বলেও দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলো একই দিনে কাছাকাছি স্থানে কর্মসূচি পালন করলে সংঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও সহনশীলতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হবে। জনগণের নিরাপত্তা ও বিশৃঙ্খলা মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক থাকতে হবে।