বাংলাদেশে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, আমলাতন্ত্র, এক নায়কতন্ত্রের কথা শোনা যায়। সরকারী কোনো প্রতিষ্ঠান তন্ত্রের বেড়াজালে বন্দি থাকবে এমনটা খুব কম শোনা যায় না। তেমনি এক প্রতিষ্ঠানের নাম রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ)। এই গুরুত্বপুর্ণ সরকারী প্রতিষ্ঠানটি পরিবারতন্ত্রের দখলে। পরিবারতন্ত্র গিলে খাচ্ছে রাজশাহী নগরবাসীর সেবা। গ্রাহকরা কোনো কাজ নিয়ে গেলে এ পরিবারতন্ত্রের কবলে পড়ে প্রতিনিয়ত নাজেহাল হচ্ছেন। এতে আরডিএ’র সেবা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এমনকি সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
জানা যায়, আরডিএ’র মোট কর্মকর্তা কর্মচারির সংখ্যা ১০৭ জন। এরমধ্যে কর্মকর্তা মোট ১৭ জন। স্থায়ী কর্মচারি ৪৭ জন ও অস্থায়ী কর্মচারি ৪৩ জন। এরমধ্যে বেশ কয়েকজন অবসরে গেছেন।
দেখা গেছে, আরডিএ’র অফিসে বাইরের লোকজন খুব কমই নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু যারা এখানে বর্তমান চাকরি করছেন তাদের পরিবারের লোকজনই রয়েছে অধিকাংশ। এক একটি পরিবারের সাতজন, ৫ জন, ৪ জন পর্যন্ত আরডিএ অফিসে চাকরি করছেন। হাতে গোনা দুএকজন আছেন যারা বাইরের কর্মচারি।
অভিযোগ রয়েছে আরডিএ অফিসে পরিবারতন্ত্রের সুবাদে যারা চাকরি পেয়েছেন তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের নিয়োগে জটিলতাও রয়েছে। যার মামলা চলমান। এখন প্রশ্ন হলো এই পরিবারতন্ত্র ভেদ করে একজন গ্রাহক কিভাবে আরডিএ’র সেবা পাবে ? আরডিএ’র বিশেষ বিশেষ চেয়ারগুলোই পরিবারতন্ত্রে দখলে রয়েছে। নগরবাসীর ধারণা পরিবারতন্ত্রের নিয়োগে কর্মকর্তারা সহযোগিতা করেছেন। যা ব্যাপক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
১ম পরিবার : আরডিএতে সার্ভেয়ার পদে চাকরি করতেন আব্দুল গাফ্ফার। তিনি কর্মরত থাকা অবস্থায় তার পরিবারের মোট ৬ জনকে চাকরি নিয়ে দিয়েছেন। এরমধ্যে আব্দুল গাফ্ফরের ছেলে রুহুল আমিন, ভাই আলতাফ হোসেন, জামাই আনোয়ার হোসেন, আলতাফ হোসেনের ভায়রা ভাই রেজাউল করিম, ভাই মুনসুর আলী, গাফ্ফারের ভাগনে রুস্তম আলী। অবসরপ্রাপ্ত রুস্তম আলী বর্তমান দুদকের মামলায় অর্ন্তভুক্ত।
২য় পরিবার : মৃত আব্দুস সাত্তার প্রহরী পদে চাকরি করতেন। কিন্তু নিয়োগ জটিলতার কারণে মারা যাওয়ার পরও তার মামলা চলমান। বর্তমান আরডিএতে তার পরিবারে কর্মরত আছেন চারজন। এরমধ্যে আব্দুস সাত্তারের জামাই আব্দুল মতিন বর্তমান নিম্নমান সহকারী হিসাবে কর্মরত। এই পরিবারে আরো রয়েছেন ছেলে ঈমান হোসেন। গার্ড পদে রয়েছেন জামাই মাসুদ রানা, ভাতিজা ইমরান হোসেন গাড়ি চালক পদে চাকরি করছেন ।
৩য় পরিবার : এই পরিবারে প্রধান মনিরুল ইসম। তিনি আরডিএ’র নিম্নমান সহকারী থেকে বর্তমান নাজির পদে রয়েছেন। এ পরিবারে তার স্ত্রী তসলিমা বেগম বর্তমান স্টোর ইনচার্জ ও লাইব্রেরিয়ান ভারপ্রাপ্ত পদে রয়েছেন। নাজিরের ভাই সহকারী নাজির গোলাম রসুল, ভাই মফিজুর রহমান শিবলু। যদিও সেচ্ছায় শিবলু চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন।
৪র্থ পরিবার : ঝাড়ুদার পদে ছিলেন মিন্টুরাম। তিনি অবসরে গেলেও তার পরিবারের রয়েছে তার স্ত্রী শান্তি রানি, একই পদে রয়েছেন তার সন্তান রতন রাম ও শিবু রাম। অনিয়মের অভিযোগে চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন শিবু রাম।
৫ম পরিবার : চেয়ারম্যানের গাড়ি চালক হিসাবে রয়েছেন আকরাম হোসেন। তার পরিবারে রয়েছে গার্ড পদে ফুফা মাহবুব হোসেন ও একই পদে ভাগনে উজ্জল হোসেন।
৬তম পরিবার : এস্টেট অফিসার বদরুজ্জামান। তার পরিবারে রয়েছে ইমারত পরিদর্শক পদে ভাগনে মফিদুল রহমান রনি।
৭ম পরিবার : সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী কামরুজ্জামান। তার পরিবারে রয়েছেন ভাগনি জামাই দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসাব রক্ষক আমিনুল ইসলাম খোকন ও কথিত ভায়রা ভাই আজিজুল ইসলাম।
৮ম পরিবার : প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল তারিক। তার পরিবারে রয়েছে কথিত ভাগনে প্লামবার আসরাফুল ইসলাম ও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইসমাইল হোসেন বাবু।
৯ম পরিবার : প্রশাসনিক কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন। তার পরিবারে রয়েছে জামাই ইমারত পরিদর্শক আরিফুল ইসলাম, অস্থায়ী পদে রয়েছে তার ভাই জালাল উদ্দিন।
১০ম পরিবার : উপ-সহকারী প্রকৌশলী কাজি আসাদুজ্জামান। এ পরিবারে রয়েছে তার স্ত্রী আয়শা আক্তার নকশাকার পদে, কমপিউটার অপরেটর (বর্তমান উচ্চমান সহকারী) পদে রয়েছেন তার স্ত্রীর বড় বোন ফরিদা ইয়াসমিন।
১১তম : ইউনুস আলী রয়েছেন চেয়ারম্যানের অফিস সহায়ক পদে। এই পরিবারে রয়েছে তার ভাতিজা আরিফুল ইসলাম শামীম। তিনি ইলেকট্রিক পদে চাকরি করছেন। শামীমের স্ত্রী মৌসুমী খাতুনও রয়েছেন অফিস সহায়ক পদে।
১২তম পরিবার : উচ্চমান সহকারী পদে রয়েছেন সামসুন্নাহার নুন্নি। এই পরিবারে রয়েছেন তার জামাই গার্ড পদে সুমন আলী, সুমনের ভগ্নিপতি এনামুল হকও রয়েছেন একই পদে।
এছাড়াও পরিবার ভুক্ত আরো যারা চাকরি করছেন তাদের মধ্যে উপ-সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) শহিদুল ইসলাম, তার ভায়রা ভাই শহিদুল। শহিদুল রয়েছেন হিসাব সহকারী পদে। চালক পদে আয়ুব আলী অবসরে গেলেও তার ভাই মোস্তাক আহমেদ রয়েছেন ইলেট্রিক্যাল পদে। এছাড়াও ঝাড়ুদার পদে রয়েছেন শিবলাল ও তার ভায়রা ভাই ডানিয়েল। এরপর রয়েছে চেয়ারম্যানের গাড়ি চালক নুরুল ইসলাম ও তার ছেলে কমপিউটার অপারেটর পদে মাহবুব হোসেন হৃদয়। এসও পদে কর্মরত ছিলেন, আব্দুল মান্নান, বর্তমান তার ছেলে ওবায়দুর রহমান সার্ভেয়ার পদে চাকরি করছেন।
এদিকে আরডিএ’র অনেক অস্থায়ী কর্মচারি রয়েছেন যারা আদৌ সেখানকার কর্মচারি নয়। তারা মূলত ছেলে মেয়ে বা আত্মীয়দের নামে চাকরি করছেন। যেমন, ভাগনি ইন্দ্রানির নামে চাকরি করছেন মামা সত্যনারায়ন। বাবা বকুলের নামে চাকরি করছেন ছেলে নারায়ন। এছাড়াও বাকি যেগুলো কর্মচারি এখন চাকরি করছেন তাদের মধ্যে হাতে গোনা দু’একজন বাদে বাকিরাও পরিবারতন্ত্রেও কোনো না কোনোভাবে সদস্য।
এছাড়াও বলরাম, কাজিম, কৃঞ্চ অবসরে যাওয়ার পর ছেলের নামে চাকরি করেছেন। কিন্তু বর্তমান তারা বাধ্যক্ষজনিত ও মৃত্যু হওয়ায় ছেলেদের চাকরি ছেলেরাই করছেন। এদের মধ্যে রয়েছে প্রনব, কাজল, নাইম হোসেন।
এব্যাপারে আরডিএ’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু হায়াত রহমতুল্লাহ্ জানান, আমি আরডিএ অফিসের মুখপাত্র নই। যার কারণে এসব বক্তব্য দেয়া আমার সরকারীভাবে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তিনি বলেন, আপনি চাইলে চেয়ারম্যানের বক্তব্য নিতে পারেন।
আরডিএ’র চেয়ারম্যান জিয়াউল হকের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, অফিসে আসেন তারপরে বক্তব্য দেবো। তবে রোববার চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তার দপ্তরের দায়িত্বে থাকা কর্মচারি জানান, চেয়ারম্যান বোর্ড মিটিংয়ে আছেন। পরে যোগাযোগ করার জন্য জানানো হয়।