আলমডাঙ্গা ষ্টেশনপাড়ার মোল্লা আবুল হোসেন নান্নু ও খায়রুল আনাম এর নেতৃত্বে একটি দল আলমডাঙ্গা শহরের দক্ষিণে ডামস গ্রামে অবস্থান নেয়। এ দলে ছিলেন ২২ জন বাছাই করা সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। তাদের উপর রেকি করার দায়িত্ব ছিল। দ্বিতীয় দলটি আলমডাঙ্গা ষ্টেশনপাড়ার মোল্লা আব্দুর রশিদ ও আলমডাঙ্গা থানার টেকপাড়া পাঁচলিয়া গ্রামের মোঃ জামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে ১১ নভেম্বর ১৯৭১ আলমডাঙ্গা শহরের দক্ষিণে বেলগাছী গ্রামে অবস্থান নেয়। আর তৃতীয় দলটি থানা কমান্ডার আব্দুল হান্নান ও শফিউর রহমান সুলতান জোয়ার্দার এর নেতৃত্বে ১১ নভেম্বর ১৯৭১ আলমডাঙ্গা শহরের পূর্ব দিকে বকশীপুর গ্রামে অবস্থান নেয়। ১২ নভেম্বর ১৯৭১ ভোরে হঠাৎ করে আলমডাঙ্গা শহরে গুলি বিনিময় শুরু হয়ে যায়। গুলির শব্দ আলমডাঙ্গা শহরের আশপাশ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। মোঃ আব্দুল হান্নান বকশীপুর গ্রাম হতে ও মোল্লা আব্দুর রশিদ, মোঃ জামাল উদ্দিন বেলগাছী গ্রাম হতে গুলির শব্দ শুনতে পান। তারা উভয়েই তাদের দলের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগে নিয়ে আলমডাঙ্গা শহরের কাছে উপস্থিত হন। সংবাদ নিয়ে জানতে পারেন রেকি করার সময় আলমডাঙ্গা শহরের দক্ষিণ পূর্ব কোণায় আনন্দধাম ব্রীজের কাছে রাজাকাররা মোল্লা আবুল হোসেন ও খায়রুল আনাম এর দলের মুক্তিযোদ্ধদের দেখতে পেয়ে প্রথমে গুলিবর্ষণ করে। মুক্তিযোদ্ধরা তার পাল্টা জবাব দেয়। এ ভাবে উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় শুরু হয়ে যায়। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্ধারিত তারিখ অর্থাৎ ঈদুল ফেতর এর নামাজের পূর্বে সংঘর্ষ হবার কথা নয়। তাতে আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবার আশংকা ছিল। অপ্রত্যাশিত হলেও ঘটনাটি ঘটে গেল। আলমডাঙ্গা এলাকায়া স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যদিও মুক্তিযোদ্ধাদের তুলনায় রাজাকার এর শক্তি ও সাহস নগণ্য ছিল কিন্তু রাজাকার এর গুলির জবাব না দিয়ে এড়িয়ে গেলে পালিয়ে যাবার মত মনে হতো। এতে এলাকার জনমনে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি ও সাহসের বিষয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হতে পারে। তাই তারা সবাই মিলে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে। গুলির শব্দ শুনে মুজিব বাহিনীর কমান্ডার কাজী কামাল, মারফত আলী ও কমান্ডার আবদার রহমান জোয়ার্দার দলের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগে নিয়ে এ যুদ্ধে যোগ দেন। আরও বেশ কয়েকটি ছোট ছোট মুক্তিযোদ্ধার দলও এ দিন আলমডাঙ্গা শহরের যুদ্ধে এসে যোগ দেয়। অনুমান ৫০০ মুক্তিযোদ্ধা সকাল ১০টায় আলমডাঙ্গা শহরের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত পাকিস্তানি সৈন্য, রাজাকার, মিলিশিয়া ক্যাম্পে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে। দুপুর ১২টাকর মধ্যে আলমডাঙ্গা শহরের বিভিন্ন এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে। কিন্তু তখন আলমডাঙ্গা থানা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসেনি। এ দিন শুক্রবার ছিল, দুপুর সাড়ে ১২ টায় জুমার নামাজের আযান শুরু হয়। আযানের ধ্বনি শুনে মুক্তিযোদ্ধরা গুলিবর্ষণ বন্ধ করে দেয়। সকালের যুদ্ধে কমান্ডার কাজী কামাল, মারফত আলী আলমডাঙ্গা শহরের উত্তরে কালীদাসপুর গ্রামের কাছে রেলওয়ে ব্রীজে স্থাপিত পাকিস্তানি সৈন্যের ক্যাম্প আক্রমণে নেতৃত্ব দেন। আবদার রহমান জোয়ার্দারের দল আলমডাঙ্গার সাহা পট্টিতে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ আক্রমণে নেতৃত্ব দেন। চুয়াডাংগার দিক হতে আগত পাকিস্তানি সৈন্যের গতিরোধের উদ্দেশ্যে মোল্লা আবুল হোসেন নান্নু এর নেতৃত্বে ও আলমডাঙ্গা গোবিন্দপুর গ্রামের লুৎফর রহমান, নুর মোহাম্মদ এবং অন্যান্য স্থানের বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে গঠিত একটি শক্তিশালী দল বন্ডবিল গ্রামের রেল গেট এর কাছে অবস্থান করতে থাকে। গোবিন্দপুর গ্রামের খন্দকার আশরাফ আলী আশু ও নওদা দুর্গাপুর গ্রামের আবদুল লতিফের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধার একটি ছোট দল আলমডাঙ্গা রেল ষ্ট্রেশন আক্রমণ করেন। কমান্ডার আব্দুল হান্নানের দলটি প্রথমে পার আলমডাঙ্গার দিক হতে চারতলা বিল্ডিং এ স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্প এবং এরপর আলমডাঙ্গা কলেজের উত্তর দিকে দিয়ে আন্দিয়া বাবুর বাড়িতে স্থাপিত রাজাকার ও মিলিশিয়া পুলিশের ক্যাম্প আক্রমণ করেন। মোল্লা আব্দুর রশিদ ও জামাল উদ্দিনের দলটি প্রথমে আনন্দধাম ক্যানেলের ব্রীজে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্প এবং পরে এরশাদপুর গ্রামের মধ্যে দিয়ে আলমডাঙ্গা বাজারে মসজিদের কাছে প্রবেশ করে। এ দিন দুপুর ১২ টা পর্যন্ত টেলিফোন এক্সচেঞ্চের কাছে যুদ্ধে আবদার রহমান জোয়ার্দারের দলের মুক্তিযোদ্ধা আনসার আলী শহীদ হন। এ সময়ে আলমডাঙ্গা শহর শত্রমুক্ত মনে করে মুক্তিযোদ্ধা খন্দাকার আশরাফ আলী আশু আলমডাঙ্গা রেল ষ্টেশনের কাছ থেকে মাঠের মধ্যে দিয়ে গোবিন্দপুর গ্রামে মেইন রাস্তায় আসেন। সেখান থেকে মেইন রাস্তা ধরে আলমডাঙ্গা থানার দিকে আসার পথে ত্রিমোহিনীর কাছে ডাকবাংলার সম্মুখে রাজাকার এর গুলিতে খন্দকার আশরাফ আলী আশু শহীদ হন। এর পরপরই রাজাকার এর গুলিতে ডাঃ বজলুল হক ত্রিমৌহিনীর কাছে তার নিজ বাড়িতে শহীদ হন। এদিন দুপুর ২টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা আলমডাঙ্গা থানা দখলের জন্য সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করেন। কমান্ডার জামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধার একটি দল আলমডাঙ্গা থানার দক্ষিণ দিক দিয়ে গার্লস হাই স্কুলের মধ্য হতে আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য একটি দল থানা কমান্ডার আব্দুল হান্নানের নেতৃত্বে আলমডাঙ্গা থানার পূর্ব দক্ষিণ দিক হতে আক্রমণ শুরু করেন। লাইট মেশিনগান, রাইফেল, এসএলআর, এসএমজির গুলি ও হ্যান্ড গ্রেনেড এর বিস্ফোরণের বিকট শব্দে এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। কমান্ডার আব্দুল হান্নান তখন থানার পূর্ব দক্ষিণ কোণায় অবস্থিত দিদার খানের বাড়ির ঘরে মধ্যে হতে জানালার ফাঁক দিয়ে লাইট মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করছিলেন। আর তার পাশে দাঁড়িয়ে একই জানালা দিয়ে গোলাম মোস্তফা দুলাল এসএলআর এর গুলিবর্ষণ করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ করে থানা হতে একটি গুলি এসে প্রথমে টেলিফোন পোষ্টে লাগে। টেলিফোন পোষ্ট ছিদ্র হয়ে গোলাম মোস্তফা দুলালের এসএলআর এর ম্যাগাজিনে লাগে। সেখান থেকে তার হাতে লাগে, একই গুলি কমান্ডার আব্দুল হান্নানের পেটের পাশে স্পর্শ করে। পিছনে গুলির বস্তা নিয়ে দাঁড়ানো কুরবান আলীর থোড়ায় লাগে। আহত গোলাম মোস্তফা দুলাল ও কুরবান আলীকে চিকিৎসার জন্য পিছনে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
অন্য দিকে থানার দক্ষিণ পাশের গার্লস হাই স্কুলের মধ্যে কমান্ডার জামাল উদ্দিনের পায়ে গুলি লাগে, তিনি আহত হন এবং স্থানীয় প্রণিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা গাংনী থানার সহিদুল ইসলাম থানার মধ্যে ঢুকতে যেয়ে গর্তের মধ্যে পড়ে গিয়ে বুকে প্রচন্ড ব্যথা পান। আলমডাঙ্গা থানাতে পাকা বাংকার থাকায় ও থানার চারিদিক মজবুত করে ঘেরা থাকায় মুক্তিযোদ্ধরা আলমডাঙ্গা থানা দখলে ব্যর্থ হন। বিকালে থানা কমান্ডার আব্দুল হান্নান তার দলের মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আলমডাঙ্গা স্টেশন পাড়ায় সরকারী খাদ্য গুদামে হামলা চালান। সেখানে বেশ কিছু রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
ওই দিকে রেল স্টেশনে গোবিন্দপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা নুর মোহাম্মদ জকুর কাছে ৮ জন রাজাকার অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। এ দিকে আলমডাঙ্গা শহর শক্র মুক্ত মনে করে মোল্লা আবুল হোসেন নান্নু ও খায়রুল আনাম যখন তার দলের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগে নিয়ে থানার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে পাডিয়া বাবুর ‘স’ মিল এলাকার দক্ষিণে বাউন্ডারী ওয়ালের বাহির সাইড দিয়ে পূর্ব দিকে যাচ্ছিলেন,
এমন সময় পাকিস্তানি সৈন্যের আকস্মিক গুলিতে মোল্লা আবুল হোসেন নান্নু ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। তার সাথী মুক্তিযোদ্ধরা কোন ক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। মোল্লা আবুল হোসেন নান্নুর কাছে একটি লাইট মেশিনগান ও মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কিছু টাকা ছিল, তা পাকিস্তানি সৈন্যের হস্তগত হয়। এর পর সন্ধ্যা পার হয়ে রাতের অন্ধকার নেমে আসায় এবং সারাদিন যুদ্ধে সব মুক্তিযোদ্ধা ক্লান্ত ও ক্ষুধাত্ব থাকায় এ দিন পাল্টা আক্রমণ করতে পারেনি। আলমডাঙ্গা শহরে ১২ই নভেম্বর ১৯৭১ এর ১২ ঘন্টাব্যাপী যুদ্ধে শতাীধক পাকিস্তানি সৈন্য, মিলিশিয়া পুলিশ , রাজাকার ও অবাংগালী নিহত হয়। বাকীদের মুক্তিযোদ্ধারা ছেড়ে দেয়। এ দিন যুদ্ধে ৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদন হন এবং ২জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন – (১) মোল্লা আবুল হোসেন নান্নু , পিতা- বাহার আলী মোল্লা , গ্রাম- আলমডাঙ্গা ষ্টেশন পাড়া , থানা- আলমডাঙ্গা, জেলা- চুয়াডাংগা, (২) খন্দকার আশরাফ আলী আশু, পিতা- খন্দকার শামসুল হক, গ্রাম- গোবিন্দপুর, থানা- আলমডাঙ্গা , জেলা- চুয়াডাঙ্গা,
(৩) মোঃ আনসার আলী , পিতা- ইব্রাহীম মন্ডল , গ্রাম- দেওলী, থানা- দামুড়হুদা, জেলা- চুয়াডাঙ্গা। আহত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন – (১) মোঃ জামাল উদ্দিন,
পিতা- নূর উদ্দিন, গ্রাম- টেকপাড়া পাচলিয়া, থানা- আলমডাঙ্গা, জেলা- চুয়াডাঙ্গা (২) গোলাম মোস্তফা দুলাল, পিতা- আবদুল গফুর সরদার, গ্রাম- আলমডাঙ্গা স্টেশন পাড়া, থানা- আলমডাঙ্গা, জেলা- চুয়াডাঙ্গা। ডাঃ বজলুল হক, সমাজসেবী ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের অধিকাংশ সময়ই আলমডাঙ্গা শহরে তিনি তার নিজ বাড়িতে অবস্থান করেন। এ দিন রাজাকারের গুলিতে তিনিও শহীদ হন। কুরবান আলীর বাড়ি আলমডাঙ্গা শহরের পাশ্ববর্তী গ্রাম এরশাদপুরে। আগে থেকে তার একটি চোখ নষ্ট ছিল। এ দিন কমান্ডার আব্দুল হান্নানের লাইট মেশিনগানের গুলি বস্তায় করে বহন করেন। কুরবান আলী এর আগে সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। তবে কুরবান আলী স্বাধীনতার সপক্ষের লোক ছিলেন। হাফিজ আহমেদ হাফিজ নামে একজন মিলিশিয়া পুলিশ এ দিন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন। হাফিজ আহমেদ পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগে থেকে আলমডাঙ্গা এলাকায় স্বাধীনতার সপক্ষে যুদ্ধ করেন। হাফিজ আহমেদ এর পিতার নাম কারী নওয়াব আলী, গ্রাম- হলতা, থানা- মঠবাড়িয়া, জেলা- পিরোজপুর। এ দিন গোবিন্দপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মোঃ সবেদ আলীর বিশেষ ভূমিকা ছিল।
তথ্য সংগ্রহ মো : আব্দুল হান্নান
যুদ্ধকালীন থানা গেরিলা কমান্ডার
আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা।