সে সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানে গুণীজনদের দাওয়াত করা হতো, যাতে শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক উপকারের ছিল। অন্তত শিক্ষাবান্ধব লোকজনদের গুরুত্ব পেতো বিদ্যালয়ের বিদায় অনুষ্ঠানগুলোতে। সে সময়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, শিক্ষা অফিসার ও এলাকার প্রবীণ শিক্ষকদের অতিথি করা হতো। গুণিজনরা বিদায় মঞ্চে অধিষ্টিত হতো। এদের অনেকেই অতীব গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শমূলক কতাবার্তা বলতো। শিক্ষার্থীদের উদ্যেশ্যে মানবিক অনুপ্রেরণামূলক উপদেশ ও উৎসাহ ব্যঞ্জক কথা বলতো মঞ্চে থাকা গুণিজনেরা। সববেদনা শিক্ষার্থীরা তন্ময় হয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শ্রবণ করতো গুণীদের উপদেশ ও শ্রুতিধর বানী। তখনকার বিদায় অনুষ্ঠান ছিল অনেক কল্যাণকর ও শুদ্ধতম চর্চার পরিবেশ। আর এখন স্বীয় প্রতিষ্ঠানের খোদ শিক্ষকেরাই মঞ্চে ঠাঁই পায় না, মঞ্চে জায়গা করে নেয় যারা শিক্ষার সাথে যায় না। এখানে বসে তারাই যারা নেহায়েত বকলম ও প্রতিপত্তির অধিকারী। বিদ্যালয় কতৃপক্ষ এদের দাওয়াত করে পরিবেশ পরিস্থিতি খেয়াল করে। এভাবে মঞ্চায়নও এখন রিতীমতো জিম্মিদশা।
তখনকার বিদায় অনুষ্ঠানে বিদায়ের ডাইসে (মঞ্চে) যারা বসতো তারা সবাই গুণিজন ছিল। সে সময় পাড়ার ডাব চোর, মুরগী চোর, খেতাবধারী চাটুকার, আপাদমস্তক বেয়াদবগুলো মঞ্চে বসা তো দূরের কথা অনুষ্ঠানের এলাকায়ও প্রবেশ ছিল লজ্জাবতীর মতোই বিরল। আজকাল সেটা অনেক পাল্টে গেছে। যারা ছাত্র হওয়ার গৌরব অর্জন করতে পারেনি তারাও আজ বিদায়ের মঞ্চে জবরদস্তি অতিথি ও বক্তা! তারা বিদায়ি শিক্ষার্থীদের উদ্যেশ্যে কি এমন নছিহত রাখবে, কি এমন প্রেরণার কথা বলবে, কি উপদেশবানী প্রসব করবে যারা কিনা অশিক্ষিত। অথচ তারা সুযোগ পেলে শিক্ষাগুরুর ঘাড়মটকানোর কথাও বলবে। এরা বেশীরভাগ রাজনীতির সাঁকোতে ভর করে অপরাজনীতির খেতাবধারী মুষ্টিমেয় কিছু লোক। অবশ্যই বিপরীতে সর্জ্জন, মার্জিত, গুণিজ রাজনীতিবিদরা এ মঞ্চে আসলে সমস্যা থাকার কথা না। তবে সেটা বিলুপ্ত প্রায়।
বিদায় অনুষ্ঠানে বিদায়ি শিক্ষার্থীরা সেদিন এতোটা নিরীহ, এতোটা বিনয়ী ছিল যা সে সময়ের শিক্ষার্থীরা ছাড়া এখনকার শিক্ষার্থীরা অনুধাবন করতে পারবে না। শুধুমাত্র পাঁচ বছর একসাথে পড়ালেখা করা, সবার সাথে পরিবারের সদস্যদের মতো আবদ্ধ থাকার স্মৃতিগুলো বিদায় মুহূর্তে আজব এক ম্লানময় পরিবেশে রুপ নিতো। পাঁচ বছরে যাঁদের সান্নিধ্যে বড় হয়েছে (শিক্ষাগুরু) তাঁদের কাছে গিয়ে নতশিরে বিনয়ের সাথে কদমবুচি করে দোয়া নিতো সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে সে সময়ের মুহুর্তগুলো ছিল স্বর্গীয়। এখন সেটার ভিন্নতা পেয়েছে কালের বিবর্তনে। এখন বিদায় অনুষ্ঠান আর্শ্বীবাদের মঞ্চ আর নেই। বিদায় অনুষ্ঠান এখন একপ্রকার রঙ্গশালা। গান হবে, নাচ হবে, বাজনা বাজবে। ন্যাতপেতে নামে রং মাখামাখি হয় কত অরুচির মহা আয়োজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখন শুদ্ধতম চর্চার পরিবেশ অন্ধকারে বিভু নিভি পিদিমের মতো। শিক্ষার সাথে যায় না এমন কিছুই আজ পরিলক্ষিত হয়। এভাবে যাচ্ছে শিক্ষা ও শিক্ষণের পরিবেশ।
এখন বিদায়ের অনুষ্ঠানে সেকেলের (এনালগ) পরিবেশ নেই। বিদায় মানে এখন র্যাগডে (Rag day) নামের অধুনিকতার স্পর্শ! শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে যোজন-যোজন দূরত্ব। মোবাইল ফোনে দাঁত ভিঞ্চিয়ে সেলফি! হৃদ্যতা, সম্মান, শ্রদ্ধা, স্নেহ এ শব্দগুলোর বালাইমাত্র নেই এখানে। সবখানে অস্বভাবিক পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য নয়, যেমনটি আজকাল শিক্ষাপ্রতিষ্টানের জগাখিচুড়ি পরিবেশ! সে সময়ে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের দেখলে বিনয় অবনত হয়ে দূর থেকে কোন রকম ছাড়! এখন সে পরিবেশটা গড়িয়ে হাই, হ্যালো আর সেলফিতে ব্যতি-ব্যস্ত ও দুরস্ত।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিকতার এতোটা অধঃপতন হয়েছে যার কালের স্বাক্ষি সেকালের আর এ-কালের সাঁকোতে পরিমেয়। এখন বিদায় অনুষ্ঠানে শেখ সাদীর কথা, শিক্ষকপ্রীতি হযরত ইমাম আবু হানিফার কথা, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা, শত সহস্র অমর গুণীজনের কথা উঠে আসেনা। এখন কোন রকম মাইক্রোফোন হাতে পেলেই জ্বালাময়ী কিছু স্লোগান, কিছু ধান ভাঙতে শীবেরগীত আর অপাত্রে ঘি ঢালার মতো অনধিকার চর্চা ছাড়া কিছুই নেই!
লেখক-
শিব্বির আহমদ রানা
শিক্ষক ও সংবাদকর্মী
এ জাতীয় আরো খবর ....