প্রগতিচিন্তক, শুদ্ধ সমাজ গঠনের কারিগর ও শিক্ষক আজগর আলীর ৩৭ তম জন্মদিনে মোমবাতি প্রজ্জ্বলের মাধ্যমে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। গতকাল ৫-ই জুন রাত ৮টা৩০ মিনিটে তার জন্মভূমি ফরিদপুরের ভাঙ্গা সহ দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে এ কর্মসূচী পালন করেন আজগর আলীর বন্ধু, শিক্ষার্থী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা।
মানবতাবাদী মহান পুরুষ আজগর আলী গত ১৫-ই মে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর এটিই ছিলো তার প্রথম জন্মদিন। এদিন মোমবাতি প্রজ্জ্বলের মধ্যে দিয়ে কর্মসূচী শুরু হয়। এরপর আজগর আলীর স্মৃতির উদ্দেশ্য এক মিনিট নিরবতা পালন ও তার বর্ণাঢ্য জীবনী পাঠ করা হয়।
কাউলীবেড়ার কাজী ওয়ালি উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিল আল দ্বীন মুক্তমঞ্চ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বশান্তি প্যাগোডা, গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এবং সাধারণ নাগরিক সমাজের ব্যানারে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় একযোগে এ কর্মসূচি পালিত হয়।
উল্লেখ্য, কাউলীবেড়া ইউনিয়নের মোটরা গ্রামে জন্ম নেওয়া আজগর আলী কাউলীবেড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে একই ক্যাম্পাসে অবস্থিত কাজী ওয়ালী উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাশ করেন ২০০১ সালে। উচ্চমাধ্যমিক পড়াশুনা শেষ করেন মাদারীপুরের খোয়াজপুর আবুল হোসেন কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে ২০০৩ সালে। ২০০৪-৫ সেশনে ভর্তি পরীক্ষায় টিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হিসেবে তার স্বপ্নের পথচলা শুরু করেন। প্রখর মেধাবী হিসেবে বন্ধুমহলে তার সুনাম ছিল। একাডেমিক পড়াশুনার পাশাপাশি সাহিত্য ও ইতিহাস অধ্যায়ণে ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ। বিভিন্ন লাইব্রেরিতে পড়ার জন্য দীর্ঘ সময় ব্যয় করতেন। বারো বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে অভিভাবকহীন জীবন যাপন করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। একইসাথে নিজেই নিজের অভিভাবক হবার আশ্চর্য দক্ষতার পরিচয় দিতে শুরু করেন। সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্খা থেকে সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন। আর্থিক অভাব ও পারিবারিক দুর্গতির মোকাবেলা করে দুর্মর সংগ্রামী শিক্ষাজীবন সাফল্যের সাথে সমাপ্ত করেন।
এরপর বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। শেষ মুহূর্তে প্রায় ৩১ বছর বয়সে পদার্পণ করার প্রাক্কালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের চাকরি পেয়ে ১৮ জানুয়ারি ২০১৬ থেকে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে নেন। ২০১৭ সালে তিনি বিবাহ করেন। প্রথমে প্রায় চার বছর দোলকুন্ডী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত থাকার পর বদলী হয়ে তার সর্বশেষ কর্মস্থল সিকদারকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আসেন। চাকরির পাশাপাশি তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র পড়াতেন ইংরেজি ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে।
ব্যক্তি জীবনে বিবাহিত হলেও তার জীবন ছড়িয়ে থাকতো বন্ধু-প্রতিবেশী-কবি-সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদ ইত্যাদি সব ধরনের মানুষের মধ্যে। সমাজ পরিবর্তনকামী ও প্রবল মানবতাবাদী হিসেবে বিজ্ঞজনের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেন। সত্যবাদিতা ও স্পষ্টবাদিতার জন্য অনেকেই তার শত্রু হয়েছিলো। ক্ষণজন্মা ও বিশুদ্ধ মানবিক চিন্তার অধিকারী প্রাগ্রসর আজগর আলী জাতীয় এবং বিশ্ব রাজনীতির উপর গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। পরিচিত-অপরিচিত যেকোনো মানুষের প্রতি সর্বোচ্চ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী ধারণ করে যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধার সহিত মানুষকে মূল্যায়ণ করার যোগ্যতা সম্পন্ন ছিলেন। নিজের বিপদকে তুচ্ছ জেনে অন্যের বিপদে ঝাপিয়ে পড়ার স্বভাব ছিল তার মজ্জাগত। তার ছিল স্পষ্টবাদিতা এবং সত্যবাদিতার মত প্রায় দুর্লভ কিছু গুণ। তার সাহচর্যে আসা প্রতিটি মানুষ অন্তর্গতভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রাণচাঞ্চল্যে মেতে ওঠে। তার সঙ্গ ছিল ভীষণ উপভোগ্য। চোখের সামনে ঘটমান যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক উচ্চকিত হওয়া ছিল তার স্বভাব। বন্ধু ও স্বজনের যেকোনো প্রয়োজনে এবং বিপদে ভরসা হয়ে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতির নাম আজগর আলী। রসবোধ ও উদ্দীপনার সুতিকাগার, যার কাছে এসে প্রতিটি মানুষ উদ্দীপিত হত। যার প্রতিশ্রুতির উপর নিশ্চিন্তে ভরসা রাখতে পারতেন যে কেউ। অপরের সমস্যাকে নিজের সমস্যার মত মোকাবেলা করে মানুষের পাশে দাড়ানোর প্রবণতা ছিল তার চরিত্রের বিশেষ দিক।